রাজধানীর দুই নগর ভবনের খাতা-কলমে ঢাকা এখন তিলোত্তমা নগরী। বাস্তবে দখল-দূষণে মৃতপ্রায়। উন্নয়নের নামে খানাখন্দে ভরপুর রাস্তাঘাট। খাল, খাসজমি দখল করে বড় বড় ভবন নির্মাণ। গত দেড় দশকে মেয়ররা ঢাকাকে ব্যবহার করেছেন পারিবারিক সম্পত্তির মতো। আত্মীয়স্বজনের অবাধ চাঁদাবাজি, ঠিকাদারি কাজের নামে লুটপাট, উন্নয়ন কাজে কমিশন, নিয়োগ-বাণিজ্যের মতো ঘটনা ছিল অনেকটা ওপেন সিক্রেট। নগর ভবনের কর্তা মেয়ররা জনগণের ট্যাক্সের টাকা নিয়েও করেছেন নানা ছেলেখেলা। উদ্ভট উদ্ভট ধারণা নিয়ে সেগুলো পরীক্ষা করার জন্য বেছে নিতেন রাজধানীকে। এমন নানা বাহানায় বছর বছর শত শত কোটি টাকা গচ্চা গেলেও জবাবদিহি ছিল না। মশানিধন, যানজট নিরসন, ট্রাফিক আধুনিকায়ন, সৌন্দর্যবর্ধনে পরীক্ষামূলক প্রকল্প হাতে নিয়েও গচ্চা দিয়েছেন অন্তত কয়েক হাজার কোটি টাকা। তবে এসব প্রকল্প থেকে মেয়র এবং তাদের স্বজন হাতিয়ে নিয়েছেন বিপুল পরিমাণ অর্থ। গত দেড় দশকে রাজধানী বসবাসের অযোগ্য শহরের তালিকায় ওপরের দিকে উঠলেও ভাগ্য বদলেছে দায়িত্ব পালন করা মেয়র এবং তাদের স্বজনের।
শেখ ফজলে নূর তাপস: ২০২০ সালে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র পদে দায়িত্ব নিয়ে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্সের ঘোষণা দেন ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস। এরপর সংস্থাটির অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী আসাদুজ্জামান ও প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা ইউসুফ আলী সরদারকে দুর্নীতির দায়ে চাকরিচ্যুত করেন। নিজের আধিপত্য বিস্তারে অসংখ্য কর্মকর্তা-কর্মচারীকে দুর্নীতির দায়ে চাকরিচ্যুত করেন তিনি। মেয়র থাকাকালে তার স্বৈরাচারী শাসন, শোষণ, অপকর্ম ও দুর্নীতি নিয়ে টুঁ শব্দটি করার সাহস পাননি কেউ। মন্ত্রীদের অনেককেও ধমক দিয়ে, তাচ্ছিল্য করে কথা বলতেন। সরকারি অন্য দপ্তরের প্রধানদের হুমকি দিতেন প্রায়ই।
ডিএসসিসির কর্মকর্তারা বলেন, শেখ তাপসের আচরণ ছিল স্বৈরাচারী ও হিংসাত্মক। সাবেক মেয়র সাঈদ খোকন যেসব উদ্যোগ নিয়েছিলেন, সেসব বন্ধ করে দেন তাপস। অনেক মার্কেটের উন্নয়ন কাজ অসমাপ্ত অবস্থায় ফেলে রাখা হয়। এতে সিটি করপোরেশনের কয়েক হাজার কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। তাপসের হুকুম ছাড়া করপোরেশনের কোনো কাজই হতো না। দৈনিক মজুরিভিত্তিক শ্রমিক নিয়োগ থেকে শুরু করে টেন্ডার, দোকান বরাদ্দ, উন্নয়ন প্রকল্প, উচ্ছেদ অভিযান—যাই ঘটুক, সব কিছুতেই তার অনুমতি লাগত। অনেক ফাইল প্রধান নির্বাহী পর্যন্ত গেলেই নিষ্পত্তি হওয়ার কথা; কিন্তু তিনি সেটা মানতেন না। শ্রমিক নিয়োগের তালিকায়ও তার পছন্দের বাইরে কাউকে রাখতেন না। শেখ পরিবারের সদস্য হওয়ায় তার বিরুদ্ধে কথা বলার মতো সাহস দেখাতেন না কেউ। দক্ষিণ সিটিতে ছিল তাপসের রাজার শাসন।
ডিএসসিসির স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মী মো. শরিফ হোসেন বলেন, মেয়র তাপস টাকা খেয়ে অনেক লোকের চাকরি দিয়েছেন। তিনি সবসময় হিংসাত্মক মনোভাব পোষণ করতেন। আগের মেয়র সাঈদ খোকন দক্ষ-অদক্ষ লোক হিসেবে ১ হাজার ২৭০ জনকে চাকরি দিয়েছিলেন। মেয়র তাপস আসার পর শুধু সাঈদ খোকন চাকরি দেওয়ার কারণে ৯০০ লোকের চাকরি খেয়ে ফেলেন। পরে নিজে ৪০০ লোকের চাকরি দিয়েছেন। শরিফ বলেন, স্থায়ী ৪৪ জনের চাকরিও খেয়েছেন তাপস। নিজে সরাসরি কোনো টাকা লেনদেন না করলেও তার মূল কাজ করে দিতেন সচিব আকরামুজ্জামান। ঠিকাদারি কাজের পার্সেন্টেজ লেনদেন হতো সাবেক প্রধান প্রকৌশলী আশিকুর রহমানের মাধ্যমে। আশিক দেশে কোনো লেনদেন করতেন না। সবসময় সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়ায় বসে লেনদেন করতেন।
তাপস মেয়র হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই মধুমতি ব্যাংকের সঙ্গে চুক্তি করে ডিএসসিসি। ব্যাংকটির অন্যতম বড় শেয়ারহোল্ডার তাপস। ডিএসসিসির আর্থিক ফান্ড, ট্রেড লাইসেন্স, হোল্ডিং ট্যাক্সসহ সব ধরনের লেনদেন মধুমতি ব্যাংকে স্থানান্তর করা হয়। ডিএসসিসির স্থায়ী আমানত ৫০০ কোটি টাকা এফডিআর হিসেবে মধুমতি ব্যাংকে স্থানান্তর করা হয়। চার খাল সংস্কার প্রকল্পের ৮৭৬ কোটি, শাহবাগ শিশু পার্কের উন্নয়ন কাজের ৬০৩ কোটিসহ কয়েকটি প্রকল্পের প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা ব্যাংকটিতে জমা রয়েছে।
আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও তাপসের ঘনিষ্ঠজনরা সংস্থার উন্নয়নকাজ ও বিভিন্ন কেনাকাটার সিংহভাগ কাজ করেছেন। কারসাজি করে কোনোরকম প্রতিযোগিতা ছাড়াই ৫৪০ কোটি টাকার কাজ তারা বাগিয়ে নিয়েছেন। পছন্দের লোক ও ক্ষেত্রবিশেষে অযোগ্য ব্যক্তিদের দিয়ে কাজ করানোর ফলে অনেক কাজ যথাসময়ে শেষ হয়নি।
জানা গেছে, কে কোন কাজ পাবেন, তা আগেই ঠিক করা হতো। সে অনুযায়ী দরপত্র প্রকাশ করার পর নির্দিষ্ট ব্যক্তিই কাজ পেতেন। এ প্রক্রিয়ায় ৩৭৫ কোটি টাকার উন্নয়নকাজ বাস্তবায়ন করেছে ডিএসসিসি। এর বাইরে আরও ১৬৪ কোটি টাকার কাজ বাস্তবায়ন হয়েছে। রাস্তাঘাট সংস্কার ও অবকাঠামো উন্নয়নের ১৭৪টি কাজে কোনো প্রতিযোগিতা হয়নি। প্রতিটি কাজের দরপত্রের বিপরীতে একটি করেই দরপত্র জমা হয়েছে। এভাবে ২০৪ কোটি ৭০ লাখ টাকার কাজ হয়েছে।
ঠিকাদারি কাজ দলীয় নেতাকর্মীদের মধ্যে ভাগবাটোয়ারা করে দিতেন তাপস। তিনি ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সভাপতি আবু আহমেদ মান্নাফি ও সাধারণ সম্পাদক হুমায়ুন আহমদকে একাধিক কাজ দেন। মান্নাফিকে দেওয়া গুলিস্তান এলাকায় একটি বহুতল ভবনের দুটি বেজমেন্ট ও একটি আন্ডারগ্রাউন্ডের নির্মাণকাজ চলছে। এতে করপোরেশন ২৫ কোটি টাকা বরাদ্দ রেখেছে। আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরীকে ৩০ কোটি টাকার একটি কাজ দেওয়া হয়েছে। ১৫ কোটি টাকা ব্যয়ে ধানমন্ডি লেক সংস্কারের কাজ দেওয়া হয়েছে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ স্বেচ্ছাসেবক লীগের কামরুল হাসান রিপনকে। ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের আওতাধীন প্রতিটি থানার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে কাজ দিয়েছেন তাপস। ছাত্রলীগ, যুবলীগের কেন্দ্রীয় নেতাসহ সংগঠন দুটির থানা, এমনকি ওয়ার্ড পর্যায়ের নেতাদেরও কাজ দিয়েছেন।
মেয়র থাকাকালে তাপস ভারী গাড়ির ১৪৩ জন চালক, ৬৬ জন উপসহকারী প্রকৌশলী, ৭৭ জন হিসাব সহকারী, ২৭ জন রেভিনিউ সুপারভাইজার, ৩১ জন পরিচ্ছন্ন পরিদর্শক, ২০ জন স্প্রে-ম্যান সুপারভাইজারসহ বিভিন্ন বিভাগে ৮৭৯ জনবল নিয়োগ দেন। নিয়োগ পাওয়া বেশিরভাগ কর্মকর্তা-কর্মচারী মেয়রের পছন্দের লোক, আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মী। নিয়োগে ১০ থেকে ১২ লাখ করে টাকা নেওয়া হয়েছে।
সহকারী সচিব পদে নিয়োগ পেয়েছেন ধানমন্ডি থানা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি আবদুল্লাহ আসিফ। রাজস্ব বিভাগের উপ-কর কর্মকর্তা পদে নিয়োগ পাওয়া ৯ জনের সাতজনই ছাত্রলীগের নেতাকর্মী। উপ-কর কর্মকর্তা পদে নিয়োগ পাওয়া মুন্সি গিয়াস উদ্দিন ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক পদপ্রার্থী ছিলেন। তার বাড়ি গোপালগঞ্জে। ডিএসসিসির ১৬ নম্বর ওয়ার্ডের এক আওয়ামী লীগের নেতার মেয়ে সাদিয়া সারওয়ার আলী, সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ ছাত্রলীগের সাবেক নেতা রফিকুল ইসলামকেও একই পদে চাকরি দেওয়া হয়েছে। উপ-কর কর্মকর্তা পদে চাকরি পাওয়া সৈয়দ সাদমানের পরিবারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা রয়েছে। ২৯ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর জাহাঙ্গীর আলমের জামাতা তাসিম হাসান উপ-কর কর্মকর্তার চাকরি পেয়েছেন।
সহকারী স্বাস্থ্য কর্মকর্তা পদে নিয়োগ পাওয়া শিহাব উদ্দিন কলাবাগান থানা ছাত্রলীগের সাবেক সহসভাপতি। রাজস্ব বিভাগে রাজনৈতিক বিবেচনায় গত ৪ বছরে ১০৪ জনকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। দলীয় বিবেচনায় নিয়োগপ্রাপ্তরা মেয়র তাপসের লোক পরিচয় দিয়ে রাজস্ব বিভাগে প্রভাব খাটাতেন। পরিচ্ছন্নতা পরিদর্শকের মধ্যে ছাত্রলীগের সাবেক নেতা পাঁচজন। নিউমার্কেট থানা ছাত্রলীগের সাবেক নেতা সাদ্দাম হোসেন, ঢাকা কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সাবেক নেতা খলিলুর রহমান পরিচ্ছন্নতা পরিদর্শক পদে চাকরি পেয়েছেন। আরেক পরিদর্শক রাসেল হাওলাদারের বাবা এলিফ্যান্ট রোড ইউনিট আওয়ামী লীগের নেতা।
হাতিরঝিল থানা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক নাদিম শিকদার একজন কর্মকর্তার ব্যক্তিগত সহকারী হিসেবে কাজ করছেন। ১৫ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক তামজিদ রহমানকে ব্যক্তিগত সহকারী পদে চাকরি দিয়েছেন তাপস। তিনি তাপসের সহকারী একান্ত সচিব নাছিরুল হাসানের খালাতো ভাই। রেন্ট অ্যাসিস্ট্যান্ট পদে নিয়োগ পাওয়া সাইফুল ইসলাম একসময় ধানমন্ডি থানা ছাত্রলীগের কমিটিতে ছিলেন। একই পদে নিয়োগ পাওয়া শ্রাবণী আক্তার ছাত্রলীগের সাবেক এক নেতার স্ত্রী। নিয়োগ পাওয়া ৩৪ জন উপসহকারী প্রকৌশলীর বেশিরভাগই রাজনৈতিক তদবির ও ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। অফিস সহকারী পদে নিয়োগপ্রাপ্ত ৬৫ জনের সবাই তাপসের অনুগত।
পার্কিং, মাঠ ও পার্ক, ফুডকোর্টসহ অনেক স্থাপনা ইজারা দেয় ডিএসসিসি। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানারসের সামনের খালি জায়গা ইজারা পান তাপসের পছন্দের কাউন্সিলর নারগিস মাহতাব। তিনি কাউকে দরপত্র কিনতে দেননি। মতিউর রহমান পার্ক ইজারা নেন ৯ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মোজাম্মেল হকের লোকজন। ধূপখোলা মাঠের উন্নয়ন কাজ করেন ৫৯ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর আকাশ কুমার ভৌমিক। তার রয়েছে মেসার্স প্রভাতি অ্যান্ড কোম্পানি এবং মেসার্স তালুকদার অ্যান্ড কোম্পানি নামে কনস্ট্রাকশন প্রতিষ্ঠান। পুরো সিটি করপোরেশনের ইজারা, টেন্ডার কার্যক্রম সব তাপসের পছন্দের লোকজনই পেতেন। এ ছাড়া করপোরেশনের মালিকানাধীন ৯৩টি মার্কেট রয়েছে। এর মধ্যে মেরাদিয়া বাজার, খিলগাঁও কাঁচাবাজার, সিদ্দিকবাজার, বঙ্গবাজার, নিউমার্কেটসহ কমপক্ষে ১০ মার্কেট তাপসের আমলে নির্মাণাধীন। এরই মধ্যে এসব মার্কেটের দোকানের বরাদ্দপত্র শেষ হয়েছে। এর মধ্যে প্রতিটি মার্কেটের ৩০ শতাংশ দোকান মেয়র কোটায় বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। আর এসব বরাদ্দ তার আত্মীয়, কাউন্সিলরসহ আওয়ামী লীগের নেতারা পেয়েছেন।
তাপসের মামা বলে পরিচিত মো. ফারুক ও মাসুদ সেরনিয়াবাত করপোরেশনে ছিলেন সর্বেসর্বা। তাদের ভয়ে নগরভবনে কেউ কথা বলতেন না। দুজনই মেয়রের ডান হাত হিসেবে করপোরেশনের ইজারা, ঠিকাদারি কাজ নিয়ন্ত্রণ করতেন। গড়ে তুলেছিলেন মামা সিন্ডিকেট।
মামাদের কথা না শুনলে ডিএসসিসির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চাকরি থেকে সাময়িক অব্যাহতি, হামলা-মামলা দিয়ে হয়রানি করা হতো। তাপসের ক্ষমতাবলে তার মামারা শত শত কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। ধানমন্ডি ও বনানীতে একাধিক ফ্ল্যাট, কেরানীগঞ্জ ও মোহাম্মদপুরে একাধিক প্লট কিনেছেন। গাজীপুর গার্মেন্টস ব্যবসায় বিনিয়োগ করেছেন। তাদের দুজনের দখলে ১০ কোটি টাকা মূল্যের ২০টি দোকান আছে। আজিমপুর নতুন মার্কেটে আত্মীয়স্বজনের নামে ১০টি দোকান বরাদ্দ নিয়েছেন। সিটি করপোরেশনের প্রতিটি মার্কেট থেকে মাসে ১০ লাখ টাকা চাঁদা নিতেন মামারা। জাকের সুপার মার্কেটের সভাপতিকে মারধর করে মার্কেট দখল করান কাউন্সিলর আওয়ালকে দিয়ে। মার্কেটের ব্যবসায়ীদের কাছে প্রতি মাসে বিদ্যুৎ বিল নিলেও তা জমা না দিয়ে আত্মসাৎ করেছেন দুই মামা ও কাউন্সিলর আওয়াল। কোটি টাকা বিদ্যুৎ বিল বকেয়া রয়েছে। তাপসের সঙ্গে মামারা সিটি করপোরেশনের টাকায় বিদেশ ভ্রমণ করেছেন।
ঠিকাদার, ইজারাদার ও কাউন্সিলরদের সঙ্গে কমিশন বাণিজ্যের লিয়াজোঁ করতেন এপিএস নাসিরুল হাসান সজীব। প্রতি ওয়ার্ডের উন্নয়ন বাজেটের ১৫ শতাংশ কমিশন নিতেন। সিটি করপোরেশনের নামে তোলা চাঁদার বড় অংশ পেতেন সজীব। ধানমন্ডি ও মোহাম্মদপুরে রেস্টুরেন্ট, ফ্ল্যাট ও জমি কিনেছেন। করপোরেশনের মার্কেটে দোকান নিয়ে আত্মীয়স্বজনের নামে দিয়েছেন। নারায়ণগঞ্জে জমি, দোকান ও বাড়ি কিনেছেন। তার দুটি গাড়ি আছে। দুবাইয়ে টাকা পাচারের অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে। তাপসের আশীর্বাদপুষ্ট ছিলেন মোর্শেদ কামাল। তাপসের কাছের মানুষ পরিচয় দিয়ে ঠিকাদারি, তদবির করে রাতারাতি আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়েছেন।
আতিকুল ইসলাম: ডিএনসিসির তৎকালীন মেয়র আনিসুল হকের মৃত্যুর পর ২০১৯ সালে উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগের সমর্থনে আতিকুল ইসলাম জয়লাভ করেন। পরের বছর নির্বাচনে তিনি ফের মেয়র নির্বাচিত হন। এই সাড়ে পাঁচ বছরে ডিএনসিসি নগর ভবন দুর্নীতির আখড়া হয়ে উঠেছিল। পারিবারিক সিন্ডিকেট গড়ে অর্থ লুটপাটে মেতেছিলেন আতিকুল। উপদেষ্টা বানিয়েছিলেন ভাগনে-ভাতিজাকে। অভিযোগ রয়েছে, মেয়র থাকাকালে কমিশন নিয়ে ঠিকাদারি কাজ দিয়েছেন তিনি। নিয়োগ বাণিজ্য, বদলি-পদোন্নতি, ময়লা বাণিজ্যও চলেছে সমানতালে। অন্যায় কাজে সম্মতি না দেওয়ায় নগর ভবন ছাড়তে বাধ্য করা হয়েছে একাধিক কর্মকর্তাকে।
শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর আত্মগোপনে চলে যান আতিকুল। গত ১৭ অক্টোবর রাজধানীর মহাখালীর ডিওএইচএস এলাকা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। মোহাম্মদপুর থানায় দায়ের হওয়া একটি মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে বর্তমানে তিনি কারাগারে আছেন।
২০২২ সালে আতিকুল ইসলাম ভাতিজা ইমরান আহমেদ ও ভাগনে তৌফিক আহমেদকে তার উপদেষ্টা পদে নিয়োগ দেন। কিছুদিন পর তার মেয়ে বুশরা আফরিন হন ডিএনসিসির চিফ হিট অফিসার। একটি আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার পক্ষ থেকে তাকে এই নিয়োগ দেওয়া হয়। চিফ হিট অফিসারের পরামর্শে নগরীর তাপমাত্রা হ্রাসে বিভিন্ন আইল্যান্ডে গাছ লাগায় ডিএনসিসি। কিছু সড়কে গাড়ি থেকে পানি ছিটানোর (কৃত্রিম বৃষ্টি) কাজে খরচ করা হয় প্রায় ২ কোটি টাকা।
২০২৩ সালে শক্তি ফাউন্ডেশনকে সবুজায়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেন আতিকুল। প্রতিষ্ঠানটির প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী পরিচালক হুমায়রা ইসলাম সম্পর্কে তার শ্যালিকা। এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে মেয়রের ভাই সাবেক প্রধান বিচারপতি তোফাজ্জল হোসেন, ভাতিজা ইমরান এবং মেয়ে বুশরা আফরিনও যুক্ত ছিলেন। আর ভাগনে তৌফিক ও এপিএস ফরিদের দায়িত্ব ছিল ঠিকাদারি কাজের ভাগবাটোয়ারা ও কমিশন আদায়। মেয়র থাকাকালীন আতিকুল যেখানেই যেতেন, তার সফরসঙ্গী হতেন তৌফিক। ঠিকাদার ও কর্মচারী-কর্মকর্তারা তাকে দ্বিতীয় মেয়র হিসেবেই চিনতেন। তার কথায় কর্মকর্তারা উঠতেন-বসতেন। সিটি করপোরেশনের কোনো পদে না থেকেও সব কর্মকাণ্ডে ছিল তৌফিকের নিয়ন্ত্রণ। এমনকি কর্মকর্তাদের নিজস্ব সভায়ও উপস্থিত থাকতেন তিনি।
এপিএস ফরিদের স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন বিডি ক্লিনের ব্যানারে বেশ কয়েকটি প্রোগ্রাম করেন মেয়র। ২০২১ থেকে ’২২ সালের মধ্যে বিশেষ অনুদান হিসেবে এই সংগঠনকে অন্তত ২২ লাখ টাকা দেয় ডিএনসিসি। এরপর আরও বেশ কয়েকবার অনুদান দেওয়া হলেও সেই কাগজপত্র খুঁজে পাচ্ছেন না সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। তারা ধারণা করছেন, করপোরেশন থেকে চলে যাওয়ার আগে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ নথি গায়েব করেন মেয়রের লোকজন। সেসব নথিতে তাদের আরও অনেক অপকর্মের প্রমাণ রয়েছে।
সিটি করপোরেশনের একাধিক কমকর্তা-কর্মচারী জানিয়েছেন, তার ভাগনের এতটাই দাপট ছিল যে, কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী তাকে সমীহ না করলে কিংবা সালাম না দিলে চাকরির ক্ষেত্রে সমস্যার সম্মুখীন হতে হতো। আর এ প্রশ্রয়দাতা ছিলেন মেয়র আতিক। মেয়র সিটি করপোরেশনের সব কাজ দিতেন তার আত্মীয়স্বজনের মধ্যে। সিটি করপোরেশনের ইতিহাসে সরকারের অনুদান থেকে শুরু করে বিভিন্ন খাতের টাকা লুটপাট করেছেন আতিকের আশপাশের লোকজন। তারা এখনো সিটি করপোরেশনে বহাল আছেন। আবার আতিকের অনেক কাছের লোক ভুয়া ভাউচার দেখিয়ে সিটি করপোরেশনের ফান্ড থেকে টাকা তুলেছেন।
মেয়রের ঐচ্ছিক তহবিল থেকে আতিকুল পাঁচ অর্থবছরে ব্যয় করেছেন ৩৭ কোটি টাকার বেশি। এর মধ্যে দেড় কোটির টাকার হিসাব দিয়েছে ডিএনসিসির সমাজকল্যাণ ও বস্তি উন্নয়ন বিভাগ। বাকি সাড়ে ৩৫ কোটি টাকার হিসাব গোপন রাখা হয়েছে। মেয়রের ঐচ্ছিক তহবিল থেকে অনুদান পাওয়া একটি সংগঠন ‘বিডি ক্লিন’। এর প্রতিষ্ঠাতা মেয়রের এপিএস ফরিদ। সংগঠনটি দুই ধাপে মোট সাড়ে ১২ লাখ টাকা অনুদান পেয়েছে। আরেক প্রতিষ্ঠান গানের স্কুল ‘সুরের ধারা’ গড়ে উঠেছে মোহাম্মদপুরের সাতমসজিদ হাউজিং-সংলগ্ন রামচন্দ্রপুর খাল ভরাট করে। এর প্রতিষ্ঠাতা রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা। সিএস দাগ অনুসারে স্কুলটির দখল করা জায়গায় প্রবহমান খাল ছিল। গত জানুয়ারি এ স্কুলকে ঐচ্ছিক তহবিল থেকে ১০ লাখ টাকা অনুদান দেন আতিক।
রাতের ঢাকায় আলো ছড়াতে ইউরোপ থেকে আনা হয় ৫০ হাজার সড়কবাতি। বলা হয়েছিল, এসব বাতি ৫০ শতাংশ বিদ্যুৎ সাশ্রয় করবে। এমনকি আধুনিক এসব বাতি কেন্দ্রীয় তদারকির মাধ্যমে জ্বালানো-নেভানো যাবে, অকেজো হলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে জানা যাবে। ১০ বছরের ওয়ারেন্টিযুক্ত বাতিগুলো লাগানোর পরের পাঁচ বছর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব ছিল সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের। কোনো বাতির আলো ৭০ শতাংশে নেমে এলে সেটি বদল করার শর্ত ছিল চুক্তিতে। কিন্তু ডিএনসিসির সড়কে শেষ পর্যন্ত দেখা গেছে নিম্নমানের সিএফএল বাতি। যদিও ৩৬৯ কোটি ১৪ লাখ ৩২ হাজার টাকায় কেনা দুই ধরনের ৪৮ হাজার ৮১২টি বাতির প্রতিটির দাম পড়েছে ৩৮ হাজার ৫০০ টাকা। লাগানোর মাসখানেকের মধ্যে সেগুলো বিকল হতে শুরু করে। সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান আর বদলে দেয়নি। এ ব্যাপারে নীরব থেকেছে ডিএনসিসি কর্তৃপক্ষ। তখন চাউর হয়, প্রতিটি বাতির প্রকৃত দাম ছিল ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা। এই প্রকল্পে লুটপাট হয়েছে বিপুল অর্থ।
মেয়র থাকাকালেই আতিকুলের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের কর্মসূচি বাস্তবায়নের নামে বস্তি উন্নয়নের টাকা লুটপাটের অভিযোগ ওঠে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে খরচ হিসাব করে দেখা গেছে, বস্তি উন্নয়ন বিভাগের আড়াই কোটির বেশি টাকা লুটপাট হয়েছে কয়েকটি রাজনৈতিক কর্মসূচির নামে।
২০২২ সালের ১৫ আগস্ট তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বনানী কবরস্থানে আগমন উপলক্ষে প্যান্ডেল, গেট ও লাইটিং করে ডিএনসিসি। এ বাবদ খরচ দেখানো হয় প্রায় ৫০ লাখ টাকা। ওই বছরের ৯ সেপ্টেম্বর শেখ রাসেলের জন্মদিন উপলক্ষে একই স্থানে একই খাতে প্রায় ১০ লাখ টাকা খরচ দেখানো হয়। ৩ নভেম্বর জেলহত্যা দিবসেও প্রধানমন্ত্রীর আগমন উপলক্ষে সেখানে ১০ লাখ টাকা খরচ দেখায় ডিএনসিসি। তা ছাড়া মেট্রোরেলের উদ্বোধন উপলক্ষে ৪১ লাখ টাকা খরচ দেখানো হয়। বিজয় দিবস উপলক্ষে মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে খরচ দেখানো হয় ৪০ লাখ ৩০ হাজার টাকা। ওই বছরের ১২ সেপ্টেম্বর ডিএনসিসির উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বিদেশিদের অবহিত করতে একটি পাঁচতারকা হোটেলে প্রায় ৫০ লাখ টাকা খরচ করা হয়। বার্ষিক বনভোজন ও করপোরেশন সভায় খরচ দেখানো হয় ৬৫ লাখ টাকা। সব খরচ করা হয় সমাজকল্যাণ ও বস্তি উন্নয়নের বরাদ্দ থেকে।
পদ্মা সেতুর উদ্বোধন উপলক্ষে বিভিন্ন সড়কে আলোকসজ্জার নামে প্রায় ৭০ লাখ এবং এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের উদ্বোধন অনুষ্ঠানের নামে প্রায় ৫০ লাখ টাকা খরচ দেখান আতিকুল। অভিযোগ রয়েছে, এই অর্থের একটি বড় অংশ গেছে তার পকেটে।
২০২১ সালের ২৩ অক্টোবর বেরাইদের একটি রিসোর্টে ডিএনসিসির উন্নয়ন কর্মকাণ্ড ও ভবিষ্যৎ কর্মপরিকল্পনা নিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন আতিকুল ইসলাম। ওই সভায় খরচ হয় ১০ লাখ টাকা। কিন্তু ভাউচার তৈরি করা হয় ২৯ লাখ টাকার। ওই ভাউচারে সই করতে রাজি না হওয়ায় তৎকালীন জনসংযোগ কর্মকর্তা আবুল বাশার মো. তাজুল ইসলামকে মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে চট্টগ্রামে বদলি করা হয়।
২০২৩ সালের ২ মে আতিকুল ইসলাম তৎকালীন ট্রাফিক ইঞ্জিনিয়ারিং সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আরিফুর রহমানকে দরপত্র ছাড়াই সরাসরি বিটিআই টেকনোলজি কোম্পানি থেকে পাবলিক প্রকিউরমেন্ট বিধিমালা ২০০৮-এর ৭৬(১) ধারায় ৪৯ লাখ ৮৬ হাজার টাকার মালপত্র কেনার নির্দেশনা দেন। আরিফুর বিধিমালা ভেঙে মেয়রের এই নির্দেশনা বাস্তবায়ন না করায় তাকে ওই পদ থেকে অপসারণ করা হয়। চারটি প্রকল্পে দায়িত্বে অবহেলা, অসদাচরণ ও অদক্ষতার অভিযোগ এনে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়। পরে তাকে গাজীপুরে বদলি করা হয়। দেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর আরিফুর রহমান স্থানীয় সরকার বিভাগে এ ব্যাপারে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন।
সাঈদ খোকন : অবিভক্ত ঢাকা সিটির মেয়র মোহাম্মদ হানিফের ছেলে সাঈদ খোকন ২০১৫ সালে ডিএসসিসির মেয়র নির্বাচিত হন। দায়িত্ব নেওয়ার পর বিভিন্ন সময়ে মুখে স্বচ্ছতার বুলি থাকলেও কয়েক মাসের মাথায় লুটপাটে জড়িয়ে পড়েন। ক্ষমতার দাপটে অনিয়ম-দুর্নীতির বরপুত্র বনে যান। গড়ে তোলেন শক্তিশালী সিন্ডিকেট। নিয়োগ, ময়লা কমিশনের বিনিময় নিজের পছন্দের ঠিকাদারদের কাজ দেওয়াসহ বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতিতে জড়ান। মেয়রের পরিচয় দিয়ে তার স্বজন, নিকটাত্মীয় ও বন্ধুবান্ধবরা হয়েছেন কোটি কোটি টাকার মালিক। আট বছরের ব্যবধানে সাঈদ খোকনের নিজের হিসাবে আয় বেড়েছে সাড়ে ২৭ গুণের বেশি। সিটি করপোরেশনের প্রতিটি উন্নয়ন প্রকল্প থেকে বড় অঙ্কের কমিশন আদায়সহ নানা দুর্নীতি, মশা নিধনে অকার্যকর ওষুধ ব্যবহার করে সমালোচিত ছিলেন।
সাঈদ খোকনের বিরুদ্ধে শতকোটি টাকার ঘুষ কেলেঙ্কারির অভিযোগ রয়েছে। ডিএসসিসির তিনটি মার্কেটে অবৈধ দোকান নির্মাণের সুযোগ, বিদেশ ভ্রমণসহ নানা অজুহাতে তিনি এ ঘুষ নেন। ১০০ কোটির মধ্যে কমপক্ষে ৩৫ কোটি টাকা ব্যাংকিং চ্যানেলে নিয়েছেন তিনি। টাকা দিয়েও কাঙ্ক্ষিত সুবিধা না পেয়ে সাঈদ খোকনের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করেন ব্যবসায়ী দেলোয়ার হোসেন। অর্থের বিনিময়ে করপোরেশনের তিনটি মার্কেটে অবৈধভাবে ৯১১টি দোকান তৈরি করেছিলেন দেলোয়ার ও তার সহযোগীরা।
মামলা করার পর সে সময় দেলোয়ার হোসেন সাংবাদিকদের কাছে দাবি করেন, ‘সাবেক মেয়র সাঈদ খোকনকে আমি ১০০ কোটি টাকার বেশি দিয়েছি। তিনি ২০ লাখ থেকে শুরু করে এককালীন ২ কোটি টাকা পর্যন্ত নিয়েছেন। মার্কেটে উচ্ছেদ অভিযান চালানোর হুমকি দিয়ে টাকা আদায় করতেন। টাকা নিলেও তিনি ব্যবসায়ীদের জন্য কিছুই করেননি। এ কারণে আমি তার বিরুদ্ধে মামলা করেছি। আমার কাছ থেকে নগদে এবং চেকের মাধ্যমে টাকার পাশাপাশি নানা ধরনের সুবিধা নিয়েছেন। মাঝেমধ্যেই অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার বিমান টিকিট ও সিঙ্গাপুরে মেরিনা বে সেন্ডস নামে সেভেনস্টার হোটেলে রুম বুকিং করে দেওয়ার বায়না ধরতেন। সেগুলোর পেছনেও অনেক টাকা গেছে। আমার প্রতিষ্ঠানের নির্মাণকাজের বিল ছাড় করাতেও মেয়রকে কোটি কোটি টাকা ঘুষ দিতে হয়েছে। ১৩ কোটি টাকার বিল ছাড় করাতে তাকে ৪ কোটি টাকা দেওয়ারও নজির আছে।’
জানা গেছে, নগরীর ফুলবাড়িয়ায় অবস্থিত নগর প্লাজা, সিটি সুপার মার্কেট ও জাকির সুপার মার্কেট। মার্কেট তিনটির মালিক ডিএসসিসি। পর্যায়ক্রমে নির্মাণ শেষে ব্যবসায়ীদের কাছে এ দোকানগুলো বিক্রি করা হয়। সিটি করপোরেশনের প্রথম শ্রেণির ঠিকাদার দেলোয়ার হোসেনের মালিকানাধীন হৃদী কনস্ট্রাকশন মার্কেট নির্মাণের কাজ করে। পরে তিনটি মার্কেটই নিজের নিয়ন্ত্রণে নেন ঠিকাদার দেলোয়ার। এর ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতিও হন তিনি।
খোকন মেয়র থাকাকালে নগর ভবনে চলে জসিমউদ্দিন সবুজ ও আমিনুল ইসলাম বিপ্লবের অলিখিত শাসন। নিয়োগ-বদলি, টেন্ডার, তদবিরসহ সবকাজেই তাদের হস্তক্ষেপ ছিল। মেয়র সাঈদ খোকনের বন্ধু পরিচয়ে দাপিয়ে বেড়াতেন। তাদের দাপটে কাজ পেতেন না সাধারণ ঠিকাদাররা। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নোয়াব এন্টারপ্রাইজের মালিক আমিনুল ইসলাম বিপ্লব কোতোয়ালি থানা আওয়ামী লীগের নেতা। একই থানা আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক ছিলেন জিহান কনস্ট্রাকশন ও এইচপিজে ঠিকাদারি ফার্মের মালিক জসিমউদ্দিন সবুজ। এ দুই ঠিকাদার কয়েকশ কোটি টাকার কাজ করেছেন।
ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি লিয়াকত সিকদার জেএসএমসিডব্লিউ বিডি কনস্ট্রাকশনের মাধ্যমে করপোরেশনের নতুন চার ইউনিয়নে উন্নয়ন প্রকল্প, ত্রিমুখী প্রকল্প, ফাইভ জোন প্রজেক্ট, ফ্লাইওভারের নিচে বিশেষ প্রকল্পসহ আনুমানিক দেড়শ থেকে দুইশ কোটি টাকার কাজ করেছেন। খোকনকে ম্যানেজ করে সাবেক এমপি নুরুন্নবী চৌধুরী শাওন অন্তত ৩০০ কোটি টাকার কাজ করেছেন।
ইসলামী ইন্স্যুরেন্সের হাজার কোটি টাকা লোপাটের অভিযোগ রয়েছে সাঈদ খোকনের বিরুদ্ধে। আট উদ্যোক্তা পরিচালককে সরিয়ে স্ত্রী, বোন, ভগ্নিপতিসহ পরিবারের ৮ সদস্যকে করেছেন এর পরিচালক। এভাবেই তিনি প্রতিষ্ঠানকে কুক্ষিগত করে হাজার কোটি টাকা লুটপাট করেছেন বলে বিতাড়িত পরিচালকরা অভিযোগ করেছেন।
ডিএসসিসির সাবেক মেয়র ও ঢাকা-৬ আসনের সাবেক এমপি সাঈদ খোকন ২০১২ সালে অনিয়মতান্ত্রিকভাবে আগের চেয়ারম্যান তোফাজ্জল হোসেনকে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিয়ে নিজেই ইসলামী ইন্স্যুরেন্সের চেয়ারম্যান পদে অধিষ্ঠিত হন। দীর্ঘ ১২ বছর নির্বাচন ছাড়াই বেআইনিভাবে তিনি এ পদে বহাল থেকে নানা দুর্নীতি ও অনিয়মে জড়িয়েছেন।
এসব কাজে তাকে সহযোগিতা করছেন কোম্পানির সিইও মো. আব্দুল খালেক মিয়া, সিএফও মো. মঈনুল আহছান চৌধুরী (সোনার বাংলা ও তাকাফুল ইন্স্যুরেন্স থেকে দুর্নীতি ও অর্থ কেলেঙ্কারির দায়ে বহিষ্কৃত) এবং কোম্পানি সচিব চৌধুরী এহসানুল হক। সাঈদ খোকন কোনো নির্বাচন বা নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করেই চাচা মো. ইসমাইল নওয়াবকে প্রতিষ্ঠানের ভাইস চেয়ারম্যান পদে বসিয়েছেন। সেখানে কোনো কমিটিও গঠন করা হয়নি। নিয়ন্ত্রক সংস্থার বাধ্যবাধকতার কারণে যা করা হয়েছে, তা হয়েছে শুধু কাগজে-কলমে এবং চেয়ারম্যান সাঈদ খোকনের নির্দেশনায়।
মেয়র হওয়ার আগে সাঈদ খোকনের বার্ষিক আয় ছিল ৪১ লাখ ৭৪ হাজার টাকা। গত সংসদ নির্বাচনের আগে তা দাঁড়ায় ১১ কোটি ৫৩ লাখ টাকা। হলফনামা অনুযায়ী, ৮ বছরের ব্যবধানে তার আয় বেড়েছে ২৭ গুণের বেশি।