দালাল না ধরলে পাসপোর্ট পেতে চরম ভোগান্তি!

চট্টগ্রামের মনসুরাবাদের বিভাগীয় পাসপোর্ট অফিসের সামনেই বড় করে লেখা, ‘অবাঞ্ছিত ব্যক্তির নিকট যাবেন না, প্রতারণার শিকার হবেন না।’ অর্থাৎ শব্দটি দ্বারা দালাল না ধরার কথাই ইঙ্গিত করা হলেও বাস্তবতা বলছে ভিন্ন কথা। পাসপোর্ট করতে আসা সেবাগ্রহীতারা বলছেন, দালাল ধরলে পাসপোর্ট করা একেবারেই সহজ। আর না হয় নানাভাবে পড়তে হয় হয়রানির মুখে। লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয় দীর্ঘসময়। ‘পান থেকে চুন খসলেই’ পড়তে হয় বড় বিপদে। সামান্য ভুলে সৃষ্টি হয় বড় বিপত্তি। যে কারণে ভুক্তভোগীদের কাছে আপদের চেয়েও দালাল ভালো।

অভিযোগ রয়েছে, সহযোগিতার কথা বলে প্রতি ফাইলে ঘুষ নেওয়া হয় ১৬০০ টাকা। প্রতিদিন যার পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ৮ লাখ ৮০ হাজার টাকায়। সে হিসাবে বছরে এই অফিস থেকে ঘুষ লেনদেন হয় ২৩ কোটি ২৩ লাখ টাকা। একই অবস্থা চান্দগাঁও আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসেও। সেখানেও সাড়ে ৪ লাখ টাকার ঘুষ লেনদেন হয়। সে হিসাবে প্রতি মাসে লেনদেন হয় প্রায় কোটি টাকা।

সংশ্লিষ্টরা এসব বিষয় অস্বীকার করলেও ভুক্তভোগীরা বলছেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ভালো কাজ ম্লান হচ্ছে এসব অভিযোগের কারণে। ফলে এসব স্থানে আরও বেশি জবাবদিহি আনা দরকার।

সোমবার (২ ডিসেম্বর) সকালে চান্দগাঁও আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে কথা হয় পটিয়া থেকে আসা প্রান্ত বড়ুয়া রাসেল নামে একজনের সঙ্গে। তিনি কালবেলাকে বলেন, পাসপোর্ট অফিসের লোকজন বলছেন, আপনার কাজগুলো এক মাস হয়ে গেছে। পুলিশ রিপোর্ট দেয়নি এখনো। আমি বললাম, এ মুহূর্তে আমি কী করতে পারি? তখন তারা পুলিশ সুপার কার্যালয়ের একটি নম্বর দিয়েছেন। সেখানে দেখা করতে বলেছেন। বুঝতে পারছি না কী করব। সবকিছু বরাবর দিয়েছি। চেয়ারম্যান সার্টিফিকেট থেকে শুরু করে প্রতিটি কাগজ সঠিকভাবে জমা দিয়েছি। তারপরও হয়রানি করছেন তারা।

বাঁশখালী থেকে আসা এসএম রহমান জব্বার বলেন, স্বাভাবিকভাবে ১৫ দিনের মধ্যে ১০ বছরমেয়াদি ৬৪ পৃষ্ঠার পাসপোর্ট নিতে খরচ হয় ৬ হাজার ৩২৫ টাকা। কিন্তু দালাল ধরে দ্রুত সময়ের মধ্যে শেষ করেছি। খরচ হয়েছে ১২ হাজার টাকা।

মিরসরাই থেকে মনসুরাবাদের বিভাগীয় পাসপোর্ট অফিসে আসা একজন বলেন, সরাসরি পাসপোর্ট করতে গেলে নানা ঝামেলা মোকাবিলা করতে হয়। কোনো ট্র্যাভেল এজেন্ট কিংবা দালালদের ৩ থেকে ৫ হাজার টাকা বাড়তি দিলে পাসপোর্ট অনায়াসে হয়ে যায়। তাই তাদের বেশিরভাগই দালালের মাধ্যমে পাসপোর্ট করেছেন।

একই কথা বলেন সীতাকুণ্ড থেকে আসা আব্বাস উল্লাহও। তিনি বলেন, সরাসরি করলে হয়রানির শিকার হতে হয়। যেমন এটা ঠিক নেই, ওটা শর্ট আছে বলে ভোগান্তিতে ফেলা হয়। বিদেশে যাওয়ার জন্যই ঝামেলা ছাড়া দালালকে দিয়ে এই কাজটি করিয়েছি।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের (টিআই) জরিপে ঘুষের তালিকায় তৃতীয় স্থানে থাকা পাসপোর্ট অধিদপ্তরের চট্টগ্রামের দুটি অফিসে বছরে অর্ধশত কোটি টাকা ঘুষ লেনেদেনের খবর পাওয়া গেছে।

জানা যায়, মনসুরাবাদ বিভাগীয় পাসপোর্ট অফিসে প্রতিদিন ৮০০ থেকে ৯০০টি ই-পাসপোর্টের ফাইল জমা হয়, যার মধ্যে প্রায় ৫৫০টি দালালের মাধ্যমে জমা হয়। প্রতি ফাইলে ১৬০০ টাকা ঘুষ নেওয়া হয়, ফলে প্রতিদিন ঘুষের পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ৮ লাখ ৮০ হাজার টাকা। সপ্তাহে পাঁচ দিনে মোট ৪৪ লাখ টাকা এবং মাসে ২২ দিনে ১ কোটি ৯৩ লাখ ৬০ হাজার টাকা ঘুষ আদায় হয়। বছরে এই ঘুষের পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ২৩ কোটি ২৩ লাখ টাকা।

চান্দগাঁও আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে প্রতিদিন ৫০০ থেকে ৫৫০টি ই-পাসপোর্টের ফাইল জমা হয়, যার মধ্যে দালালের মাধ্যমে জমা হয় ৩০০ থেকে ৩৫০টি। প্রতি ফাইলে ১৫০০ টাকা ঘুষ নেওয়া হয়, ফলে প্রতিদিন ঘুষের পরিমাণ দাঁড়ায় সাড়ে ৪ লাখ টাকা। সপ্তাহে পাঁচ দিনে মোট ২২ লাখ ৫০ হাজার টাকা এবং মাসে ২২ দিনে প্রায় ১ কোটি টাকা। বছরে এই ঘুষের পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ১২ কোটি টাকা। দালালদের মাধ্যমে প্রতি বছর প্রায় ৩৬ কোটি টাকা ঘুষ আদায় করা হয়। এর বাইরে মেশিন রিডেবল পাসপোর্টের (এমআরপি) জন্য আলাদাভাবে চুক্তির মাধ্যমে মোটা অঙ্কের টাকা ঘুষ নেওয়া হয়। তা ছাড়া কারও বিরুদ্ধে মামলা থাকলেও নেওয়া হয় অতিরিক্ত টাকা।

সূত্র জানায়, ঘুষের লেনদেনের পদ্ধতি এবং দালালদের ভূমিকা পাসপোর্ট অফিসের ঘুষ লেনদেনের পদ্ধতি অত্যন্ত সুসংগঠিত। প্রতিটি পাসপোর্ট ফাইলে দালালদের একটি সাংকেতিক চিহ্ন থাকে, যা অফিসের কর্মকর্তারা সহজেই চিহ্নিত করতে পারেন। এই সাংকেতিক চিহ্ন ৭৭ নম্বর কলামে দালালের ইমেইল আকারে দেওয়া হয়। সাধারণত পাসপোর্ট আবেদনকারীরা যদি এই সাংকেতিক চিহ্ন ব্যবহার না করেন, তবে তাদের নানা অজুহাতে হয়রানি করা হয়। ফলে সহজ-সরল লোকের নানাভাবে হয়রানি শিকার হন।

চক্রের এক সদস্যের সঙ্গে গ্রাহক সেজে পরিচয় গোপন করে আলাপ হয় এই প্রতিবেদকের। আলাপের শুরুতে দিলেন একটি ভিজিটিং কার্ড। ভিজিটিং কার্ডে নাম সাহাব উদ্দিন, পদবিতে লেখা আছে আল-সারা ইন্টারন্যাশনাল ট্র্যাভেল এজেন্টের পরিচালক। চকবাজারের একটি মার্কেটে তার অফিস। শুরুতেই সাহাব উদ্দিন বলেন, আমি যে ফাইল করে দেব, সেটা নিয়ে অফিস কাউন্টারে কোনো প্রশ্ন করবে না। যেখানে মনসুরাবাদে ফটোকপির ওপর সিল দেব আর এখানে ব্যাংক ভাউচারের ফটোকপিতে আরেকটি সিল দেব। দায়িত্বরত কর্মকর্তারা দেখলেই বুঝে নেবেন ফাইলটি কার। না হয় বাড়ি ও ঠিকানাসহ নানা প্রশ্ন করবেন তারা। সিল থাকলে আর কোনো হয়রানির শিকার হতে হবে না আপনাকে। পুলিশ রিপোর্টে দেড় হাজার টাকা, ব্যাংকের চালান ১০০, যেখানে চালান ৫০ টাকা ও ভ্যাট ৫০ টাকা অন্তর্ভুক্ত হবে। আমাকে মোট ১১ হাজার ৫০০ টাকা দিতে হবে, এটা ১০ বছরের জন্য আর্জেন্ট। নরমাল পুলিশ ভেরিফিকেশনসহ ১০ হাজার ৫০০ টাকা দিতে হবে।

পুলিশকে টাকা না দিলে ভেরিফিকেশন হবে না কেন প্রশ্ন করলে এই দালাল বলেন, রিপোর্ট তো দেবেই না বরং নানা ঝামেলা সৃষ্টি করবে। আমার হাতের লেখা কাগজ এই পাসপোর্ট অফিসে ১০০ রিম আছে। এখানে আমার মতো অভিজ্ঞ আরও চার থেকে পাঁচজন আছেন।

এসব অভিযোগ নিয়ে কথা হয় চট্টগ্রাম বিভাগীয় পাসপোর্ট অফিসের পরিচালক মো. সাঈদুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি কালবেলাকে বলেন, এক বছর ধরে আমার অফিস কমপাউন্ডে কোনো দালাল প্রবেশ করতে পারেনি। বাইরে থেকে যদি কেউ এমন কাজের সঙ্গে জড়িত থাকে, তাহলে তা আমার জানা নেই। আমার অফিসের আনসার থেকে শুরু করে কেউই এ কাজে জড়িত নয়। আমরা চেষ্টা করি সেবাগ্রহীতাদের দ্রুত সময়ের মধ্যে যেন সেবা দেওয়া হয়

যদি এমন হয় কোনো গ্রাহক আমাদের অফিসে এসেছেন, কিন্তু কর্মকর্তারা তাদের কথা শোনেননি। তাহলে আমি দায়িত্ব নিতে পারি। কিন্তু সেরকম ঘটনা গত দুয়েক বছরে ঘটার কোনো সুযোগ দেওয়া হয়নি। এর বাইরে বলতে গেলে, আমাদের সার্ভিসটি প্রযুক্তি ও তথ্যনির্ভর। কেউ যদি তাদের ফরম পূরণের সময় ভুল তথ্য আপলোড করেন, তাহলে তো আমার কর্মকর্তারা তা নিয়ে আর এগোতে পারবেন না। গত কিছুদিন ধরে যে ভুলটা বেশি দেখছি তা হলো- এনআইডি কার্ডে নাম, পরিচয়সহ তথ্য থাকে এক রকম, আবার অন্যান্য কাগজ কিংবা আমাদের সার্ভারে আপলোড করা তথ্য থাকে ভিন্ন রকম। এখন এসব ঘটনার জন্য যদি আমার কর্মকর্তারা সেই ফাইল ফিরিয়ে দেন কিংবা সংশোধন করতে দেন, তাহলে দোষের কিছু দেখছি না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *