ভারতে শেখ হাসিনার ১০০ দিন কেমন কাটল?

সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। ফাইল ছবি

গণঅভ্যুত্থানের মুখে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে গত ৫ আগস্ট ভারতে আশ্রয় নেন শেখ হাসিনা। এখনো সেখানেই আছেন তিনি। বৃহস্পতিবার (১৪ নভেম্বর) দেশটিতে শেখ হাসিনার অবস্থানের ১০০ দিন পূর্ণ হলো। এই দিনগুলো তার কেমন কাটল তা নিয়ে জনমনে প্রশ্ন আছে।

শেখ হাসিনা যে ভারতে আছেন তা নিশ্চিত করলেও তিনি কোথায় এবং কীভাবে আছেন সে বিষয়ে ভারত সরকার এখন পর্যন্ত কোনো ধরনের তথ্য প্রকাশ করেনি। তার অবস্থান সম্পর্কে তথ্য না থাকলেও তিনি ভারতে কী ধরনের নিরাপত্তা বা আতিথেয়তা পাচ্ছেন এবং চরম অস্বাভাবিক একটা পরিস্থিতিতে তিনি স্বাধীনভাবে কতটা কী করতে পারছেন তা নিয়ে অনেকের মনেই প্রশ্ন উঠতে পারে।


অপ্রত্যাশিত অথচ অতি গুরুত্বপূর্ণ অতিথি শেখ হাসিনার জন্য ভারত এখন ঠিক কোন ধরনের নিরাপত্তা প্রোটোকল অনুসরণ করছে? এই বিষয়ে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসির পক্ষ থেকে ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের শীর্ষস্থানীয় এক কর্মকর্তার কাছ জানতে চাওয়া হয়েছিল।


জবাবে ওই কর্মকর্তা সংক্ষেপে তিনটি বিষয় উল্লেখ করেন।


তিনি জানান, শেখ হাসিনাকে ততটুকু নিরাপত্তাই দেয়া হয়েছে যেটুকু না হলেই নয়। তার চারপাশে ঘিরে রয়েছেন সাদা পোশাকের রক্ষীরা, জলপাই রঙা উর্দির কমান্ডো বা সেনা সদস্যরা নন।


এই পুরো বিষয়টার মধ্যে কোনো আতিশয্যের বালাই রাখা হয়নি বলে জানিয়েছেন ওই কর্মকর্তা। অর্থাৎ ঢাকঢোল পিটিয়ে বা ঘটা করে তাকে কোনো নিরাপত্তা দেয়া হচ্ছে না।


দ্বিতীয়ত তিনি জানান, শেখ হাসিনার ক্ষেত্রে গোপনীয়তাই হলো নিরাপত্তা। বিবিসি বলছে, দিল্লিতে শেখ হাসিনার নিরাপত্তার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি জোর দেয়া হয়েছে গোপনীয়তার ব্যাপারে। কারণ, তিনি কোথায় এবং কীভাবে আছেন সেটা যতো বেশি গোপন রাখা যাবে ততই তার নিরাপত্তা নিশ্ছিদ্র করা সহজ হবে।


ওই কর্মকর্তা আরো জানান, শেখ হাসিনাকে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় নিয়ে যাওয়া কিংবা তার সঙ্গে অন্যদের দেখা করানোর ব্যবস্থা যতোটা সম্ভব এড়ানোর চেষ্টা করা হচ্ছে।

বিবিসি বলছে, শেখ হাসিনার চলাফেরা কিংবা অন্যদের সঙ্গে দেখা সাক্ষাত যে পুরোপুরি বন্ধ নয় তার ইঙ্গিত ওই কর্মকর্তার কথাতেই ছিলো। শেখ হাসিনাকে যাতে কোনোভাবেই প্রকাশ্যে আসতে না হয় এই প্রোটকলে সেই চেষ্টাও বিশেষভাবে লক্ষণীয়।


গত ২৪ অক্টোবর ভারতীয় সংবাদমাধ্যম দ্য প্রিন্ট এক প্রতিবেদনে শেখ হাসিনার অবস্থান সম্পর্কে তথ্য দেয়। এতে বলা হয়, নয়াদিল্লির লুটিয়েন্স বাংলো জোনের একটি বাড়িতে গত দুই মাস ধরে বসবাস করছেন শেখ হাসিনা। বাংলাদেশের সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীর জন্য কঠোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছে ভারত সরকার।


প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, লুটিয়েন্স বাংলো এলাকায় ভারতের মন্ত্রী, সিনিয়র এমপি ও শীর্ষ কর্মকর্তাদের জন্য বরাদ্দ করা বাড়ির মতো একটিতে শেখ হাসিনাকে থাকতে দেয়া হয়েছে। যদিও তার গোপনীয়তা ও নিরাপত্তার স্বার্থে দ্য প্রিন্ট বাড়িটির প্রকৃত ঠিকানা বা রাস্তার বিবরণ প্রকাশ করেনি।

ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ৫ আগস্ট বাংলাদেশ থেকে ভারতের গাজিয়াবাদের হিন্দন বিমানঘাঁটিতে আসার দুই দিনের মধ্যে হাসিনাকে নিরাপদে অন্যত্র সরিয়ে নেয়া হয়। কারণ সেখানে থাকার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা ছিল না। পরে লুটিয়েন্স দিল্লির নিরাপদ ও সুরক্ষিত এলাকায় একটি বাড়িতে তার থাকার ব্যবস্থা করা হয়।
 

দ্য প্রিন্টের প্রতিবেদনে শেখ হাসিনার নিরাপত্তায় সার্বক্ষণিক সাদা পোশাকে নিরাপত্তাকর্মীরা রয়েছেন বলে জানানো হয়েছিল। শেখ হাসিনা দুই মাসের বেশি সময় ধরে ওই এলাকায় বসবাস করছেন উল্লেখ করে প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, সেখানে তার থাকার সব ব্যবস্থা করা হয়েছে। যথাযথ প্রটোকলসহ হাসিনা মাঝেমধ্যে পাশের লোধি গার্ডেনে হাঁটতে যান বলেও প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছিল। একটি সূত্রের বরাতে দ্য প্রিন্টকে জানায়, ‘বাইরে যাওয়ার প্রয়োজন হলে নিরাপত্তায় নিয়োজিতদের জানানো হয় এবং সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হয়।’
 

তবে বিবিসির প্রতিবেদন বলছে ভিন্ন কথা। শেখ হাসিনা যে দিল্লির লোধি গার্ডেনে মাঝে মাঝে এসে হাঁটাহাঁটি করে যাচ্ছেন কিংবা ইচ্ছা করলে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় নিজামউদ্দিন আওলিয়ার দরগায় কাওয়ালী শুনে আসছেন- এই ধরনের যাবতীয় জল্পনা হেসেই উড়িয়ে দিচ্ছেন ভারতের সংশ্লিষ্ট মহলের কর্মকর্তারা।


বিবিসি বাংলা জানিয়েছে, গত ১০০ দিনে ভারতে শেখ হাসিনার পুরনো পরিচিতদের মধ্যে কেউ কেউ তার সঙ্গে সামনা-সামনি দেখা করার সুযোগ পেয়েছেন। এই সুযোগ সীমিত হলেও ভারত সরকার সেটা দিয়েছে।

গত প্রায় তিন মাসে শেখ হাসিনার অনেকগুলো কথিত ফোনকল সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। এতে এক পক্ষের কণ্ঠস্বর হুবহু শেখ হাসিনার কণ্ঠস্বরের মতো শোনাচ্ছে। একাধিক পদস্থ সূত্রের বরাতে বিবিসি জানিয়েছে, এগুলো শেখ হাসিনারই কণ্ঠস্বর। শেখ হাসিনা যেহেতু ভারতে গৃহবন্দী কিংবা রাজনৈতিক বন্দি নন ফলে দেশ-বিদেশে তার পরিচিত জন কিংবা দলীয় নোতকর্মীদের সঙ্গে ফোনে কথা বলার সুযোগ পাচ্ছেন। দিল্লিতে থাকা মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ এবং যুক্তরাষ্ট্রে থাকা ছেলে সজিব ওয়াজেদের সঙ্গে তার প্রতিনিয়তই যোগাযোগ হচ্ছে। টেলিভিশন, সংবাদপত্র কিংবা ইন্টারনেটে তার সম্পূর্ণ এক্সেস আছে। তবে ভারতের মাটিতে বসে তিনি যাতে এখনি নিজের বয়ানি কোনো রাজনৈতিক বক্তব্য না দেন সেজন্য তাকে ভারতের পক্ষ থেকে অনুরোধ জানানো হয়েছে।


শেখ হাসিনার সরকার পতনের পর বাংলাদেশে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করে দেশ পরিচালনা করছে। এদিকে জুলাই-আগস্টে আন্দোলনকারীদের হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে দেশজুড়ে বহু মামলা হয়েছে। তাকে দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের মুখোমুখি করার দাবিও উঠেছে বিভিন্ন মহল থেকে। এরইমধ্যে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল থেকে তার নামে গ্রেফতারি পরোয়ানাও জারি করা হয়েছে।

শেখ হাসিনাসহ পলাতক আওয়ামী লীগ নেতাদের গ্রেফতারে ইন্টারপোলের রেড নোটিশ জারির বিষয়ে পদক্ষেপ নিচ্ছে সরকার। গত মঙ্গলবার (১২ নভেম্বর) পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) মো. ময়নুল ইসলামকে এ সংক্রান্ত চিঠি পাঠান আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালের চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম।


এর আগে আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল জানান, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে দায়ের করার জুলাই-আগস্ট গণহত্যা মামলার আসামি শেখ হাসিনাসহ সব পলাতক আসামিদের ফিরিয়ে আনতে সব ধরনের পদক্ষেপ নেবে সরকার।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *