পাকিস্তান ও বাংলাদেশ সরাসরি নৌবাণিজ্য শুরু ভারতের উদ্বেগ

সাগরপথে বাণিজ্যিক সম্পর্কের ঐতিহাসিক যুগে বাংলাদেশ-পাকিস্তান প্রবেশ করলেও ভারত উদ্বিগ্ন। টেলিগ্রাফ ইন্ডিয়ার নিবন্ধে বলা হয়েছে, স্বাধীনতা যুদ্ধের পর এই প্রথম কোনো পাকিস্তানি মালবাহী জাহাজ বাংলাদেশের বন্দরে ভিড়েছে। গত বুধবার পাকিস্তানের করাচি থেকে ছেড়ে আসা জাহাজটি বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বন্দরে ভেড়ে। নানা কারণেই পাকিস্তানি মালবাহী জাহাজটির বাংলাদেশের বন্দরে ভেড়ার বিষয়টিকে ঐতিহাসিক বলা হচ্ছে। আর এই ঐতিহাসিক বিষয়টি নিয়ে উদ্বিগ্ন ভারত।

টেলিগ্রাফ ইন্ডিয়ার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভারতের পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চলীয় দুই প্রতিবেশীর মধ্যে এ ধরনের সরাসরি সামুদ্রিক সংযোগে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব উপকূলের কাছাকাছি থাকার কারণে ভারতীয় উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির সম্ভাবনা আছে। বাংলাদেশে নিযুক্ত পাকিস্তানের হাইকমিশনার সৈয়দ আহমেদ মারুফ সরাসরি এই শিপিং রুটকে পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ও ব্যবসায়িক সম্পর্কের উন্নয়নে একটি বড় অগ্রগতি হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন, এই উদ্যোগটি কেবল বিদ্যমান বাণিজ্যের গতি বাড়াবে না, বরং উভয় দেশের ব্যবসা, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে বড় রফতানিকারকদের জন্য নতুন সুযোগ সৃষ্টি করবে।’ গত আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। হাসিনা সরকারের পতনের পর বাংলাদেশের নতুন অন্তর্বর্তী সরকার পাকিস্তানের সঙ্গে সরাসরি সমুদ্রপথে বাণিজ্য স্থাপনের মাধ্যমে বাণিজ্য বৃদ্ধির আশা প্রকাশ করেছে। ২০২৩ সালে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যের পরিমাণ ৮০০ মিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে গিয়েছিল।

পাকিস্তান ও বাংলাদেশের সরকারি মহলে এই বিষয়টি নিয়ে আশাবাদ থাকলেও ভারতীয় এক কৌশলগত বিশেষজ্ঞ সতর্ক করেছেন যে, এই সম্পর্ক ভারতের জন্য উদ্বেগের কারণ হতে পারে। মাত্র তিন মাস আগেও দুই দেশের (বাংলাদেশ-পাকিস্তান) সম্পর্ক তিক্ত ছিল। ওই বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘বাংলাদেশের চট্টগ্রাম ও মংলা এ দুটি প্রধান বন্দর গত পাঁচ দশক ধরে পাকিস্তানের জন্য নিষিদ্ধ ছিল… দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য সিঙ্গাপুর বা কলম্বোয় ট্রানশিপমেন্টের মাধ্যমে হতো।’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই বিশ্লেষক আরও বলেন, ‘এখন পাকিস্তানি জাহাজ সরাসরি চট্টগ্রামে আসবে, ফলে অবৈধ পণ্য বাংলাদেশের মাধ্যমে ভারতে পৌঁছে যেতে পারে এমন আশঙ্কা একেবারেই উড়িয়ে দেয়া যাচ্ছে না।’ এ সময় তিনি ২০০৪ সালে চট্টগ্রামে অবৈধ অস্ত্রের বিশাল চালান আটক হওয়ার ঘটনাটি উল্লেখ করেন। এই ঘটনা দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাসে সবচেয়ে বড় অস্ত্র আটকের ঘটনা।

টেলিগ্রাফ ইন্ডিয়ার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০০৪ সালের সেই অভিযানে আটক অস্ত্রগুলো পাকিস্তানি গুপ্তচর সংস্থা আইএসআই-এর অর্থায়নে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য আসামের বিদ্রোহী গোষ্ঠী উলফার কাছে পৌঁছানোর কথা ছিল। প্রায় দেড় হাজার চীনা অস্ত্র চালান ট্রলারযোগে চট্টগ্রামে পৌঁছে। যার আনুমানিক মূল্য ছিল ৪ দশমিক ৫ থেকে ৭ মিলিয়ন ডলার। এ চালানটি নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠন উলফার কাছে যাওয়ার কথা থাকলেও তা পৌঁছার আগেই আটক করা হয়।

ভারতীয় কর্তৃপক্ষ সেই সময় থেকে চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দরের সমুদ্রপথে সতর্ক দৃষ্টি রেখেছে এবং চীনের প্রভাব এড়াতে শেখ হাসিনা সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখেছিল। গত বছর মংলা বন্দরের একটি টার্মিনালের পরিচালনার বিষয়ে চীনের ওপর কৌশলগত বিজয় লাভ করেছিল ভারত। কিন্তু এখন পাকিস্তান চট্টগ্রাম বন্দরে প্রবেশাধিকার পেয়ে গেছে। এই দুই বন্দরের সমুদ্রপথ এখন পাকিস্তানি জাহাজের জন্য উন্মুক্ত হচ্ছে। মিয়ানমারও চট্টগ্রামের খুব কাছাকাছি অবস্থানে থাকায়, এ বিষয়টি আঞ্চলিক ভূ-রাজনীতিতে প্রভাব ফেলতে পারে বলে মনে করছেন ভারতের নিরাপত্তা বিভাগের একটি সূত্র।

মিয়ানমার বর্তমানে একটি অনিশ্চিত অবস্থায় রয়েছে এবং ভারতে মাদক চোরাচালান ও অনুপ্রবেশের কারণে দেশটির নিরাপত্তা বাহিনীর মধ্যে উদ্বেগ বাড়িয়েছে। পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশে আসা কার্গো জাহাজের পণ্যের বিস্তারিত জানা না গেলেও, একাধিক সূত্র জানিয়েছে যে বড় কনটেইনারগুলো প্রথমে জাহাজ থেকে নামানো হয়। তারপর বাকি পণ্যগুলো খালাস করা হয়।

এক সময় শেখ হাসিনার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করা ভারতীয় নিরাপত্তা সংস্থার এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘প্রথমে কিছু ৪০ ফুটের কনটেইনার নামানো হয় এবং সেগুলোর চারপাশে নিরাপত্তা বলয় তৈরি করতে পুলিশ মোতায়েন করা হয়। এটি সাধারণত করা হয় না। ফলে, অবৈধ পণ্য প্রবেশের সম্ভাবনাকে পুরোপুরি উড়িয়ে দেয়া যাচ্ছে না।’

পাকিস্তানের সঙ্গে সরাসরি সামুদ্রিক সংযোগ চালুর উদ্যোগকে বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা মোহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকারের একটি কৌশল হিসেবে দেখা হচ্ছে। শেখ হাসিনার সরকারের সময়ে বাংলাদেশে পাকিস্তান প্রায় একঘরে অবস্থানে ছিল। শেখ হাসিনা চলতি বছরের ৫ আগস্ট দেশজুড়ে তীব্র বিক্ষোভের মুখে দেশ ত্যাগ করেন। শেখ হাসিনার শাসনামলে, বিশেষ করে ১৯৯৬ থেকে ২০০১ এবং পুনরায় ২০০৯ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত সময়ে ভারত ও বাংলাদেশের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হয়। ভারতের একজন বিশ্লেষক বলেন, ‘ইউনূস ক্ষমতায় আসার পর বাংলাদেশ সম্পর্ক পুনর্বিন্যাস করছে… এবং তাদের অগ্রাধিকারের মধ্যে রয়েছে ভারতের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রেখে পাকিস্তানের সঙ্গে আরও ঘনিষ্ঠ হওয়া।’ তিনি আরও বলেন, ‘পাকিস্তান মূলত বিভিন্ন ধরনের তুলা বাংলাদেশে রফতানি করে, আর বাংলাদেশ জুটপণ্য রফতানি করে… তবে ভারতের প্রধান রফতানি বাজার হিসেবে বাংলাদেশের স্থান পরিবর্তন করা অসম্ভব। আমাদের উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, পাকিস্তান-বাংলাদেশের এই নতুন ঘনিষ্ঠতার কারণে আঞ্চলিক নিরাপত্তার ওপর প্রভাব পড়তে পারে।’

এ দিকে, এরই মধ্যে বাংলাদেশ নৌবাহিনী আগামী ২০২৫ সালে পাকিস্তানে অনুষ্ঠিতব্য আন্তর্জাতিক নৌমহড়া আমান-২০২৫-এ অংশ নেয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাংলাদেশী এক বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘এটি হবে প্রথমবারের মতো পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের যৌথ নৌ মহড়ায় অংশগ্রহণ… গত মাসে একটি ফ্রিগেট পাকিস্তানের উদ্দেশে যাত্রা করেছে। এসব পদক্ষেপ ভারতের জন্য উদ্বেগের কারণ হতে পারে, বিশেষ করে বঙ্গোপসাগর ও ভারত মহাসাগরে নতুন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হওয়ার আশঙ্কা থাকছে।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *